সরকারের বরাদ্দ করা ২৪ কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে, দৃষ্টিনন্দন ভবনও দাঁড়িয়ে গেছে বহু আগেই। কিন্তু মুন্সীগঞ্জে স্থাপিত ১০০ শয্যাবিশিষ্ট ডায়াবেটিক হাসপাতাল আজও পূর্ণ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেলেও চালু হয়নি ইনডোর চিকিৎসাসেবা। মূল্যবান যন্ত্রপাতি পড়ে আছে অব্যবহৃত অবস্থায়।
১৯৯৮-এ যাত্রা, সংকুচিত পরিসরে শুরু:
মুন্সীগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির উদ্যোগে ১৯৯৮ সালে এক ছোট্ট ভবনে অস্থায়ীভাবে শুরু হয় ডায়াবেটিস রোগীদের সেবা। স্থানীয় সমাজসেবী ও শিল্পপতিদের সহায়তায় পরিচালিত এ কেন্দ্র দিনে দিনে রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে থাকে।
অবশেষে ২০১৬ সালে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহায়তায় এবং সমিতির আর্থিক অংশীদারত্বে ‘মুন্সীগঞ্জ ডায়াবেটিক হাসপাতাল স্থাপন’ প্রকল্পের অনুমোদন আসে। জেলা শহরের চরশিলমন্দি এলাকায় ৮৪ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ শুরু হয় নতুন হাসপাতাল ভবনের।
সরকারি খরচে ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি সংগ্রহ—তবুও থেমে আছে সেবা:
প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ২৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ছাড়াও ডায়াবেটিক সমিতি ৫ কোটি টাকা দেয়। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলেও, এখনো চালু হয়নি হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ ইনডোর সার্ভিস।
এছাড়া রোগীদের জন্য কেনা হয় ৫৩৩টি চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি, যার মধ্যে রয়েছে অ্যানালগ এক্স-রে মেশিন, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজারসহ নানা মূল্যবান সামগ্রী। মোট ব্যয়: প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
কিন্তু ব্যবহার না হওয়ায় এসব যন্ত্রপাতির অনেকগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কোটি টাকার যন্ত্রপাতি মেঝেতে পড়ে আছে:
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলো ধুলায় পড়ে আছে হাসপাতালের মেঝেতে। নষ্ট হয়ে গেছে এক্স-রে মেশিন। সোলার প্যানেল, জেনারেটর, অফিস ফার্নিচার, পানির ট্যাংক—সবই সংগ্রহ করা হয়েছে। তবুও চালু হয়নি হাসপাতালটির প্রধান সেবা—ইনডোর চিকিৎসা।
সমিতির উদাসীনতা ও লোকবল নিয়োগ না করায় ধ্বংস হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
সীমিত জনবল, বহি বিভাগেই সীমাবদ্ধ চিকিৎসা:
হাসপাতালে বর্তমানে চালু রয়েছে কেবল বহি বিভাগ। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৬ জন চিকিৎসক আউটডোরে রোগী দেখছেন। এর মধ্যে দুজন ডেন্টাল চিকিৎসক, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান ও দুজন সহকারী চিকিৎসক রয়েছেন। গাইনী বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কোনও উপস্থিতি নেই। রেজিস্ট্রারভুক্ত রোগীর সংখ্যা ৩৬,২৩৩। প্রতিদিন শতাধিক রোগী চিকিৎসার জন্য এলেও, ইনডোর বা ভর্তি বিভাগ না থাকায় তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় অথবা বাহিরের হাসপাতালে রেফার করা হয়।
সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান বলেন,“আমরা ইতোমধ্যে ঢাকা বারডেম হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ওখান থেকে রোটেশনাল পদ্ধতিতে ডাক্তার পাঠিয়ে আমাদের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান,“শুরুর দিকে মেশিন চালানোর জন্য আমাদের কোনও প্রশিক্ষণ ছিল না। এখন আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। ল্যাবরেটরি ও অন্যান্য মেশিনগুলোর প্রশিক্ষণ নেওয়া হচ্ছে। আগামী মাসে বসে সিদ্ধান্ত নেবো কীভাবে ইনডোর চালু করা যায়।”
সরকারি অঙ্গীকার বনাম বাস্তবতা
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল—ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, রোগীদের সঠিক পরামর্শ, দরিদ্রদের জন্য অন্তত ৩০% বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং রোগীদের পুনর্বাসন।
কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে এসব লক্ষ্য অনেকটাই অধরাই রয়ে গেছে।
প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা, প্রশিক্ষণের অভাব ও উপযুক্ত জনবল নিয়োগ না থাকায় সরকারের বিশাল অর্থবিনিয়োগের সুফল পৌঁছায়নি সাধারণ জনগণের কাছে।
পরিকল্পনা আছে, কার্যকারিতা নেই:
সরকার ও সমিতি উভয়ের অংশগ্রহণে গঠিত এই প্রকল্পটি এখন একটি অচল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া, রোগীর চিকিৎসা না পাওয়া, জনবলের অভাব—সব মিলিয়ে এটি কেবল একটি অব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং জনগণের করের টাকার অপচয়ের একটি উন্মুক্ত দলিল।