আজ থেকে ২০ বছর আগে ২০০৫ সালের ৭ আগস্ট আমরা সাপ্তাহিক মুন্সীগঞ্জ সংবাদের আয়োজনে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনার শতবর্ষ উৎযাপন করেছিলাম। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট লিখেছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনার শতবর্ষ উৎযাপনের আয়োজন একমাত্র মুন্সীগঞ্জেই হয়েছিল।
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় রচিত হয়েছিলো। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি বলে গানটির সঠিক রচনাকাল খোঁজে পেতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ৭ আগস্ট উক্ত সভায় এই গানটি গাওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, ‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট রচনা করা হয় আর ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠের অনুষ্ঠানে প্রথম গাওয়া হয়। শতবর্ষ পরে আমরা ঠিক এই দিন অর্থাৎ ২০০৫ সালপর ৭ আগস্ট জাতীয় সঙ্গীত রচনার শতবর্ষ উৎযাপনের আয়োজন করি। উৎযাপন আয়োজনের প্রধান সম্বন্বয়ক ছিলেন সে সময়ের মুন্সীগঞ্জ সংবাদের প্রধান সম্পাদক শহীদ ই হাসান তুহিন। প্রধান পৃষ্ঠপোষকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তৎকালীন মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও মানবজমিন পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার মোজাম্মেল হোসেন সজল। মোজাম্মেল হোসেন সজল তখন মুন্সীগঞ্জ সংবাদের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন নিউএজ পত্রিকার সাংবাদিক নির্তেশ সি দত্ত, রিয়াজুল ইসলাম, চিত্রশিল্পী আব্দুস সাত্তার মানিক, সাংবাদিক শেখ মোহাম্মদ রতন প্রমুখ। নিমন্ত্রণ পত্র, ব্যানার ইত্যাদিতে ব্যবহারের জন্য চিত্রশিল্পী আবুল খায়ের জাতীয় পতাকার আদলে রবীন্দ্রনাথের একটি শৈল্পিক স্কেচ এঁকে দিয়েছিলেন আর অতিথিদের জন্য উপহার স্বরূপ শাল কাঠের উপর জাতীয় সঙ্গীত মুদ্রিত ক্রেস্ট তৈরি করে দেন বিন্দু সরকার।
দিনব্যাপী উৎযাপন অনুষ্ঠানটি মুন্সীগঞ্জ জেলা সার্কিট হাউসের অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সাংবাদিক শহীদ ই হাসান তুহিনের আবেদনে আগ্রহী হয়ে তৎকালীন মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক আনিস উদ্দিন মঞ্জুর মুন্সীগঞ্জ জেলা সার্কিট হাউসে জাতীয় সঙ্গীত রচনার শতবর্ষ উৎযাপনের ব্যবস্থা করে দেন।
উৎযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি সাযযাদ কদির। বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি সরকার মাসুদ ও জেলা প্রশাসক আনিস উদ্দিন মঞ্জুর। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক অনিল চক্রবর্তী, অধ্যাপক জয়ন্ত সান্যাল, তৎকালীন মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি আরিফ উল ইসলাম, সাংবাদিক সালেহীন তুহিনসহ মুন্সীগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন নির্তেশ সি দত্ত। জাতীয় সঙ্গীতের সাথে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে উৎযাপন অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়েছিল। পরে উপস্থিত অতিথিরা আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনা শেষে ছিল মধ্যাহ্ন ভোজ ও আড্ডার আয়োজন। সবশেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সৃজন, ফেরদৌসী রিফাত, প্রিয়াঙ্কা গাঙ্গুলী প্রমুখ। পরের দিন ৮ আগস্ট এনটিভিতে জাতীয় সঙ্গীত রচনার শতবর্ষ উৎযাপন অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রদর্শিত হয় এবং বেশ কয়েকটি কাগজে ‘মুন্সীগঞ্জে জাতীয় সঙ্গীত রচনার শতবর্ষ উৎযাপন’ করার নিউজ প্রকাশিত হয়। মানবজীবন পত্রিকার তৎকালীন উপসম্পাদক কবি সাযযাদ কাদির জাতীয় সঙ্গীত রচনার শতবর্ষ উৎযাপন নিয়ে মানবজীবন পত্রিকার পাতা জুড়ে একটি কলাম লিখেন।
জানা যায়, ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি তৎকালীন নদীয়া জেলার শিলাইদহে, বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহে বসে রচনা করেছিলেন। একই বছর ৭ সেপ্টেম্বর, ১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরসহ গানটি প্রথম মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয় এবং সেই বছর ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাউল’ নামক গ্রন্থে “আমার সোনার বাংলা’ পুরো গানটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাউল গায়ক গগণ হরকরার ১৮৮৯ সালে রচিত ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের সুর ও সঙ্গীত অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সুরারোপ করেন এবং ১৯০৫ সালের ২৫ অগাস্ট বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কলকাতা টাউন হলে একটি প্রবন্ধ পাঠের অনুষ্ঠানে প্রথমবার গাওয়া হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আবদুল লতিফের সুর দেওয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের সাথে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি পরিবেশন করে। এই গান গাওয়ার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ উদ্যোক্তা ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল। এরপর ১৯৫৩-‘৫৪ সালে ডাকসুর অভিষেক অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাওয়া হয়। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু গণপরিষদ সদস্যদের সম্মানে গণপরিষদ সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীতজ্ঞ সনজীদা খাতুন কর্তৃক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয়। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জহির রায়হান নির্মিত ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহৃত করা হয়। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের আবেদন ও চিত্রায়ন মুক্তিকামী বাঙালির হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে।
১ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার দুই দিন পরে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ শুরু হওয়ার আগেও গানটি গাওয়া হয়। ২৩ মার্চে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা কুচকাওয়াজে ‘আমার সেনার বাংলা’ গাওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মুজিবনগরে ‘আমার সোনার বাংলা’ প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়। যুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হয়েছে। সেখানে গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায়। ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকা বিবেচনা করে এই গানটির প্রথম দশ লাইন সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়। ১৯৭৮ সালে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।
১৯৪৮ সালে এইচএমভির লেবেলে গানটির গ্রামোফোন রেকর্ড প্রথমবার প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে ইএমআইয়ের লেবেলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত আরেকটি গ্রামোফোন রেকর্ড পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত হওয়ার পরে লন্ডনের একটি বিখ্যাত অর্কেস্ট্রা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির একটি অর্কেস্ট্রা ভার্শন করে বাংলাদেশকে উপহার দেয় যা দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের শুরুতে বাজানো হয়।
২০০৬ সালে শ্রোতাদের পছন্দ অনুসারে বিবিসি বাংলার তৈরি সেরা বিশটি বাংলা গানের তালিকায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম স্থান দখল করে। শিল্পকলা সম্পর্কিত ‘দ্য আর্টস ডেস্ক’ নামক ব্রিটিশ সাংবাদিকতা ওয়েবসাইট ২০১২ সালে স্বর্ণপদক পাওয়ার যোগ্য ১০ টা দেশের জাতীয় সঙ্গীতের তালিকা করে। যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ প্রথমদিকে স্থান পায়। ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় প্যারেড ময়দানে একসঙ্গে ২,৫৪,৫৩৭ জন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মাধ্যমে গিনেস বিশ্ব রেকর্ড করে।
আগামী ৭ আগস্ট আমাদের জতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ রচনার ১২০ বছর পূর্তি হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা