বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলা, যা প্রাচীন বিক্রমপুর নামেই বেশি পরিচিত, দীর্ঘদিন ধরেই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের একটি সমৃদ্ধ ভান্ডার হিসেবে বিবেচিত। এক সময়ের বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চল থেকে নিয়মিতভাবে বেরিয়ে আসছে মূল্যবান প্রাচীন নিদর্শন।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ধার হওয়া একাধিক বিষ্ণুমূর্তি এবং বিগত এক দশকে আবিষ্কৃত আরও বেশ কয়েকটি প্রত্ন নিদর্শন স্থানীয় জাদুঘরে স্থান না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী, গবেষক ও পর্যটকরা।
২০২৪ সালের এপ্রিল ও মে মাসে মুন্সীগঞ্জ সদর ও টংগিবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া যায় তিনটি বিষ্ণুমূর্তি। এগুলো বর্তমানে জেলা ট্রেজারিতে সংরক্ষিত রয়েছে। এর আগে ২০১৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত উদ্ধার হয় আরও অন্তত নয়টি মূর্তি ও প্রাচীন প্রত্ন নিদর্শন। কিন্তু এসব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সম্পদ স্থানীয় ইদ্রাকপুর দুর্গ জাদুঘরে দেখা যায় না।
দর্শনার্থীদের হতাশা:
মুঘল আমলের প্রতিরক্ষা স্থাপনা ইদ্রাকপুর দুর্গে ২০২২ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একটি জাদুঘর স্থাপন করে। কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, জাদুঘরে কিছু ফটোগ্রাফ, তথ্যপ্যানেল ও পোড়ামাটির রেপ্লিকা ছাড়া মূল প্রত্নসম্পদ অনুপস্থিত।
স্থানীয় বাসিন্দা এবং ইতিহাস অনুরাগীরা বলছেন, প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন হিসেবে এসব মূর্তি এবং নিদর্শন মুন্সীগঞ্জের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য বহন করে। সেগুলো জাদুঘরে প্রদর্শন না করায় এই অঞ্চলের ঐতিহ্য সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।
“প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখি মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু জাদুঘরে গেলে কিছুই দেখতে পাই না,” বলেন স্থানীয় শিক্ষক আব্দুল হান্নান। “আমাদের বাচ্চাদের কীভাবে নিজেদের ইতিহাস শেখাব?”
কি বলছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর?
তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, “আমাদের সংগ্রহে মুন্সীগঞ্জে প্রাপ্ত কোন মূর্তি নেই। ইদ্রাকপুর দুর্গে বিষ্ণু মূর্তিসহ অন্যান্য প্রত্ন নিদর্শন রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারি। তবে, প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে ইদ্রাকপুর একটি মোঘল শাসনামলের জলদুর্গ। প্রত্যেকটা যাদুঘরের একটা থিম থাকে। দুর্গে সাধারণত মুসলিম শাসনামলের তৈজসপত্র বা দুর্গে খনন করে যা যা পাওয়া যায় সেগুলো প্রদর্শিত হয়।”
বিশেষজ্ঞদের মত:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সূফী মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সম্প্রতি পাওয়া বিষ্ণুমূর্তিগুলো ১৯ শতকের এবং কালো ব্যাসল্ট পাথরের তৈরি। এগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। যেহেতু মুন্সীগঞ্জে জাদুঘর রয়েছে, সেহেতু সেগুলো এখানেই রাখা উচিত।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি জাদুঘর শুধু থিম ধরে সাজালেই যথেষ্ট নয়—স্থানীয়ভাবে পাওয়া নিদর্শন সেখানে না রাখলে ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে এর আবেদন হারিয়ে যাবে।
শেষ কথা:
মুন্সীগঞ্জের প্রত্ন নিদর্শন শুধু ইতিহাসের পাতায় বন্দি না থেকে যদি স্থানীয়ভাবে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হয়, তাহলে তা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে প্রশাসনের গতি যেভাবে ধীর, তাতে কবে নাগাদ এই অমূল্য সম্পদ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।