মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মামুনুর রশীদের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি, দায়িত্বে অনিয়ম এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে স্থানীয় প্রশাসন ও জনমত। সম্প্রতি একাধিক অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে যেখানে মামুন একটি অবৈধ বালু মহাল সংক্রান্ত বিষয়ে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করছেন। এই ঘটনা ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে এবং এলাকায় পাল্টাপাল্টি মানববন্ধনের মাধ্যমে বিভক্ত হয়েছে স্থানীয়রা।
মূল ইস্যু: অবৈধ বালু মহাল
বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি অবৈধ বালু মহাল, যা মেঘনা নদীসংলগ্ন এলাকা গজারিয়ার গুয়াগাছিয়ায় অবস্থিত। অভিযোগ অনুযায়ী, এই মহাল সরকারি অনুমোদন ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছিল এবং তা স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে স্থানীয় কিছু কথিত সাংবাদিক ও প্রভাবশালী মহলের।
সূত্র অনুযায়ী, এসিল্যান্ড মামুনুর রশীদ প্রথম দিকে এই মহালটি বন্ধে উদ্যোগ নিলেও পরে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং অর্থের বিনিময়ে মহাল চলতে দেন। অভিযোগ আরও গুরুতর হয়, যখন এক ব্যবসায়ী গোপনে ধারণকৃত একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ করেন যেখানে মামুন জানতে চাচ্ছেন, ”টাকা পাঠানোর রশীদ ফাঁস হলো কিভাবে?” তিনি আরও বলেন, “এরপর থেকে আপনি নিজে টাকা পাঠাবেন। টাকা পাঠানোর পরপরই রশীদ ছিড়ে ফেলবেন।” আরেকটি ক্লিপে ১০ লাখ টাকা দাবি করে এসিল্যান্ড মামুন বলছেন, “আগেতো ১০ দিবেন, তারপর অন্যকথা বলবো।”
তথাকথিত সাংবাদিকদের সংশ্লিষ্টতা
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে: স্থানীয় কিছু তথাকথিত সাংবাদিকের ভূমিকা। অভিযোগ রয়েছে, মামুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলের যোগাযোগ স্থাপনে তারাই মূল ভূমিকা পালন করেছে।
একাধিক স্থানীয় জানান, এই সাংবাদিকরা বালু মহালের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করার পাশাপাশি মামুনকে মিডিয়ার ভয় দেখিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করতেন।
মামুনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন
অভিযোগ ফাঁসের পরপরই গজারিয়া উপজেলায় বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদল ও ছাত্রদলের একটি অংশ একত্রিত হয়ে এসিল্যান্ডের অপসারণ দাবি করে মানববন্ধন করেন। বক্তারা বলেন, “মামুন শরীফ গজারিয়া উপজেলার বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সাইদুর রহমান গং এর মালিকানাধীন নির্মানাধীন বহুতলা বিল্ডিং এর কাজ বন্ধ করে দিয়ে ভবন মালিকদের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা দাবি করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে । আদালতের আদেশ অমান্য করে ঔ বিল্ডিং এর কাজ বন্ধ করে দেন বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে। এরপর সার্ভেয়ার কামালের মাধ্যমে অফিসে ডেকে নিয়ে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন।”
মামুনের পক্ষে পাল্টা মানববন্ধন
অন্যদিকে, এসিল্যান্ড মামুনের পক্ষে ছাত্রদলের একটি অংশ মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, গজারিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ মামুন শরীফ একজন ভালো মানুষ। গজারিয়া উপজেলায় যোগদান করার পর তিনি অবৈধ বালুমহাল পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তার নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অস্ত্র-গোলা বারুদ উদ্ধার করেছে। তার কারণে অবৈধ বালুমহাল পরিচালনা করতে সমস্যা হওয়ায় একটি প্রভাবশালী মহল তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহার করে ভুয়া কল রেকর্ড, ব্যাংকের টাকা জমা দেওয়ার রশিদ ছড়িয়ে দিয়ে এগুলো তার বলে দাবি করছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। এসবের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ করেন তারা।
মানববন্ধনে অংশ নিয়ে গজারিয়া উপজেলা যুবদলের আহবায়ক অহিদুজ্জামান অহিদ বলেন, ‘কারো কথায় প্ররোচিত হয়ে নয় বিবেকের তাড়নায় থেকে আমরা মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছি। আপনারা এসিল্যান্ড তাড়িয়ে দিয়ে আপনাদের রাস্তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবেন তা হতে দেওয়া যাবে না। আমরা তার বিরুদ্ধে করা সকল অপপ্রচারে নিন্দা জানাই’।
মানববন্ধনে অংশ নিয়ে গজারিয়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ যদি সামগ্রিক মূল্যায়ন করি তবে গজারিয়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ মামুন শরীফ তার কাজের জায়গায় সফল। তিনি মেঘনা নদীর গুয়াগাছিয়া অংশে অবৈধ বালুমহাল পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনায় করায় তারা তার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমরা তাদেরকে সতর্ক করে দিতে চাই। আপনারা এসব বন্ধ না করলে আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দিব’
মামুনের বক্তব্য
সাংবাদিকদের কাছে এসিল্যান্ড মামুনুর রশীদ তার অবস্থান তুলে ধরেন:
“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে দিয়ে সেটা আমার বলে দাবি করা হচ্ছে, আপনারা একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন এটি আমার কন্ঠ নয়। অবৈধ বালুমহাল পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে আমি ধারাবাহিকভাবে অভিযান পরিচালনা করায় তারা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। আমি সবাইকে বলব আপনারা অপপ্রচার এবং গুজবে কান দিবেন না।”
ইউএনও’র প্রতিক্রিয়া
গজারিয়ার ইউএনও মো. আশরাফুল আলম জানান:
“অভিযোগ ও অডিও ক্লিপ সম্পর্কে আমরা অবগত। এটির বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের গোপনীয় প্রতিবেদন বিভাগীয় কমিশনার অফিসে পাঠানো হয়েছে। এই ইস্যুতে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার স্থানীয় প্রশাসনের নেই। বিষয়টি আমাদের জন্যও বিব্রতকর।
তিনি বলেন, “স্থানীয়দের মধ্যে কেউ যদি এই অপরাধে জড়িত থাকেন এবং আমরা যদি কোনো দালিলিক প্রমাণ পাই, তবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”