ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২২ মে ২০২৫
  1. আন্তর্জাতিক
  2. এক্সক্লুসিভ সংবাদ
  3. খেলাধূলা
  4. গ্যালারি
  5. জাতীয়
  6. জেলার সংবাদ
  7. ফিচার
  8. মতামত
  9. রাজনীতি
  10. শিক্ষা
  11. সাহিত্য ও সংস্কৃতি

পান সুপারির পাঁচালী

নির্তেশ সি দত্ত
মে ২২, ২০২৫ ১:২৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

‘যদি সুন্দর একটা মন পাইতাম/ সদর ঘাটের পানের খিলি তারে বানায় খাওয়াইতাম…।’ বাঙলা সিনেমার এই বিখ্যাত গানে সদর ঘাটের যে পানের খিলির কথা বলা আছে সেটা আসলে বিক্রমপুর অঞ্চলের পান! প্রাচীনকাল থেকেই বিক্রমপুরের পানের সুনাম আছে। আর বিক্রমপুরের পানের বড় মোকাম এই সদরঘাট। ঢাকার সদরঘাট থেকে বিক্রমপুরের পান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ হয়, এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হয়। শুধু গানে ছড়ায় কবিতায় নয়, পান বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। শুধু বাঙালি নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির অন্যতম অনুসঙ্গ এই পানপাতা। পানের প্রচলন বহু প্রাচীন। বৈদিক যুগেও পানের ব্যবহার ছিল বলে শোনা যায়। ধারণা করা হয়, আর্যগণ প্রথম খিলি পান পরিবেশনের প্রচলন করেন। পরে এই রীতি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। উপমহাদেশের বাইরে পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি ইউরোপেও পান খাওয়ার রীতি রয়েছে। নেপাল ভুটানসহ প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের লোকজনের মাঝে পান খাওয়ার প্রচলন বেশি।

বিক্রমপুর একটি অতি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীনকাল থেকেই বিক্রমপুর পরগণার প্রায় প্রতিটি গ্রামে ‘বারই’ নামে একটি সম্প্রদায় বসবাস করে আসছে যাদের প্রধান পেশা পানপাতা উৎপাদন। পানের খামারের নাম পানবরজ হলেও এর স্থানীয় নাম ‘পান বর’। সম্ভবত ‘বর’ থেকে ‘বারই’ নামের উৎপত্তি। এরা মূলত হিন্দু কায়স্ত জনগোষ্ঠী। পানগাছকে এরা পরম সম্মানের সাথে চাষ করে, এমনকী লতাকৃতি এই গাছকে তারা ঈশ্বরজ্ঞানে পূজাও করে থাকে! পান চাষের সাথে এই সম্প্রদায়ে গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ লোকজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বারমাসে তাদের তের পার্বণ লেগেই থাকত। সর্বজনীন পূজাপার্বণের বাইরেও ছিল বাস্তুপূজা (শস্যক্ষেত পূজা), নবমীপূজা (পানের বরজ পূজা), গোলা উৎসব (জৈষ্ঠ্যমাসে নানা ফলের রস দিয়ে তৈরি ভোজ), কাসন্দি উৎসব, গাড়ুরডাল (আশ্বিনে রেঁধে কার্তিকে খাওয়া) ইত্যাদি নানা উৎসবে গ্রামগুলি মেতে উঠত।

বিক্রমপুরের পান বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী। এ অঞ্চলের পানের বিশেষত্ব এর চাষ পদ্ধতিতে। মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলের টঙ্গীবাড়ি, সিরাজদিখান, লৌহজং, শ্রীনগর ও সদর উপজেলার পাঁচ শতাধিক গ্রামে বহুকাল ধরে পানের উৎপাদন হয়ে আসছে। এখানে উন্নতমানের পান উৎপাদনের খ্যাতি বহির্বিশ্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। পান হলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার লতাজাতীয় উদ্ভিদের পাতা। পানপাতা দেখতে গোলাকৃতি, অপেক্ষাকৃত পুরো, রসালো এবং লম্বা বোঁটাযুক্ত। পান গাছ পর্ব বা গাঁটযুক্ত সরু ও দীর্ঘ উদ্ভিদ। পান গাছের লতাকে স্থানীয়গণ ‘পোঁয়ার’ বলে। এর দেহলতা পুরো এবং রসালো। প্রতিটি পর্বে বা গাঁটে একটি করে পানপাতা উৎপন্ন হয়। একটি পর্ব থেকে আরেক পর্বের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য প্রায় দুই ইঞ্চি এবং প্রতিটি পর্বের চারদিকে মূল বা আকর্ষী থাকে যা দিয়ে তুলনামূলক শক্তপোক্ত গাছ বা কোন সাপোর্টকে আঁকড়ে ধরে উপরের দিকে বেড়ে ওঠে। বিভিন্ন প্রজাতির পান রয়েছে- মিঠা, সাঁচি, কর্পূরী, গ্যাচ, নাতিয়াবাসুত, উজানী, মাঘি ইত্যাদি। Piperaceae পরিবারভুক্ত পান গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Peper betle.

অঞ্চলভেদে পান চাষ আলাদা হয়ে থাকে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত চাষ ও উৎপাদন পদ্ধতির জন্য বিক্রমপুরের পান অনন্য ও প্রসিদ্ধ। সাধারণত উঁচু ও বিস্তীর্ণ সমতল জায়গাজুড়ে পানের খামার করা হয়। পান চাষ একটি ধারাবাহিক উৎপাদন পদ্ধতি। বছরব্যাপী পান চাষ ও উৎপাদন চলতে থাকে। সাধারণত জৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে পানগাছ রোপন করে প্রাথমিক চাষ শুরু হয় এবং একবার চাষ শুরু করলে সেটা বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। অর্থাৎ প্রতি বছরই নতুন করে পান গাছ লাগাতে হয় না, একবার পান গাছ লাগিয়ে ৫ থেকে ১০, ১৫ বছর পর্যন্ত পান পাতা উৎপাদন করা হয়।
চাষের আগে বিস্তীর্ণ উঁচু জমি প্রস্তুত করে নেওয়া হয়। তারপর বৃহৎ আকারের মাচা করে মাচার ভেতরে সারি সারি কঞ্চি পুঁতে পানগাছ রোপন করতে হয়। মাচার উপর ধানের লম্বা নাড়া বা আখের পাতা বিছিয়ে এবং চারদিকে বেড়া দিয়ে সমস্ত খামারটিকে ছায়াবৃত করা হয়। পান চাষের জন্য ছায়াঘেরা পরিবেশ খুব জরুরী। পান গাছ বেড়ে ওঠার জন্য নিয়মিত বৃষ্টি অপরিহার্য। পানের উচ্চফলন পেতে পান গাছের গোড়ায় জৈবসার (খৈল ও গোবর সার) ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি লতায় সপ্তাহে প্রায় দুইটি করে পর্ব বেড়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ এক সপ্তাহে একটি লতায় দুইটি করে পান পাতা উৎপন্ন হতে পারে। লতা যখন উপরের দিকে বেড়ে ওঠতে থাকে তখন প্রতিটি লতার নিচের থেকে প্রতি সপ্তাহে একটি বা দুটি করে করে পানপাতা বোঁটাসহ তুলে নেওয়া হয়। সাধারণত উপরের দিকে আট-দশটি পানপাতা রেখে সপ্তাহে এক বা দুই বার পানপাতা তোলা হয়। উপরের দিকে উঠতে উঠতে পানলতা মাচা পর্যন্ত চলে গেলে লতাগুলোকে কঞ্চি থেকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে সারির দুইদিক পোতা কঞ্চিগুলোর মাঝখান বরাবর মাটির উপর পেঁচিয়ে বিছিয়ে দেওয়া হয় এবং লতার উপরের অংশের আট বা দশটি পাতাসহ আবার নির্দিষ্ট কঞ্চির সাথে বেঁধে দিয়ে পুনরায় উপরের দিকে বাড়তে দেওয়া হয়। পরে মাটি উপর বিছানো লতাগুলোকে নরম ও গুড়ো করা মাটি দিয়ে বেশ পুরো করে ঢেকে দেওয়া হয়। সেই মাটির উপর খৈলের গুড়ো ও গোবর সার মিশিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয় যা আগে মাটির নিচে বিছিয়ে দেওয়া পান গাছের লতাগুলোর পর্বের মূলগুলো বৃদ্ধি পেয়ে খাদ্য হিসেবে শোষণ করে। এই প্রক্রিয়ায় বৃষ্টি খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এভাবে বছরের পর বছর পানের চাষ ও পান পাতা উৎপাদন চলতে থাকে। আট-দশ বছর পরে পান গাছের দুর্বলতার কারণে পানপাতা ছোট হয়ে গেলে বা মূলকাটা রোগে বা ছত্রাকজনিত রোগে পান গাছ মরে গেলে বা মাটি বেশ উঁচু হয়ে গেলে পুনরায় মাটি সমতল করে একইভাবে নতুন মাচা তৈরি করে আবার নতুন পানগাছ রোপন করতে হয়।

পান বাংলাদেশের একটি অর্থকরী ফসল। পান উৎপাদন একটি লাভজনক ব্যবসা। নানা উৎসব, ঈদ, পূজা-পার্বণ, বিয়ে-শাদিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং বিভিন্ন শহরের খিলিপানের দোকানে পানের বিপুল চাহিদা রয়েছে। তবুও বিক্রমপুরে পান উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।পার্টিশনের পর থেকে এই অঞ্চলে এককালের সংখ্যাগরিষ্ঠ বারই সম্প্রদায়ের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকলে বিক্রমপুরে পানের বরজের খামারও কমতে থাকে। অবশিষ্ট সংখ্যালঘু এই বারই সম্প্রদায় এখনো পান উৎপাদন পেশায় যুক্ত আছে। বর্তমানে স্থানীয় অন্যান্য জনগোষ্ঠী পান চাষ পেশায় যুক্ত থাকলেও বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী পান চাষ ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। বিক্রমপুর ছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে পানের চাষ হয়। মানিকগঞ্জ, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, যশোর, জামালপুর, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে পানের চাষ হয়। বর্তমানে পান চাষে যুক্ত হয়েছে বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক প্রযুক্তি। বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র উচ্চফলনশীল, বিভিন্ন গুণাবলিসম্পন্ন এবং রোগ-প্রতিরোধে সক্ষম বারিপান-১, বারিপান-২ এবং বারিপান-৩ নামে তিনটি পানের উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশের পান বিদেশে রপ্তানীও করা হয়৷ পাকিস্তান, ভারত, সৌদিআরব, আরব-আমিরাত, ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানিসহ এশিয়া- ইউরোপের অনেক দেশে পান রফতানি হয়ে থাকে।

নিঃশ্বাসকে সুরভিত করা এবং ঠোঁট ও জিহবাকে লাল করার জন্য আর্য ও আরবগণ পান খাওয়ার প্রচলন করে।রাজা-বাদশাহদের পান খাওয়ার ঐতিহ্যও হাজার বছরের পুরোনো। যুগে যুগে রাজা-বাদশাগণ সিংহাসনে বসে শাহি মশলাযোগে পান খেতেন। পাশে পিকদান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত দাস-দাসী।বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই পানের ব্যবহার চলে আসছে। গ্রাম বাংলায় ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে পান এখনও অপরিহার্য। জমিদাররা তাদের বৈঠকখানায় মজমা বসিয়ে পান খেতেম। এখনও গ্রাম্য সালিশে বা খোশ গল্পের আসরে পান পরিবেশনের রীতি দেখা যায়। গ্রামে গঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় মহিলাদের আড্ডায় পানের বাটায় পান-সুপারির উপস্থিতি এখনো দেখা যায়। এছাড়া কোন কোন অনুষ্ঠানাদিতে পান পরিবেশন দ্বারা প্রস্থানের সময় ইঙ্গিত করা হয়। বাঙালির আতিথেয়তার ইতি পান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ঘটে। পান সাধারণত চুন, খয়ের ও সুপারি সহযোগে পরিবেশন করা হয়। পানের সাথে কেউ কেউ তামাক বা জর্দাও খেয়ে থাকেন। অনেকে ধনিয়া, এলাচি, দারুচিনি ও নানা রকম সুগন্ধি মসলা মিশিয়ে পাম খায়। কেউ কেউ এসব মসলা ছাড়াও পান খেতে পছন্দ করেন। সাধারণত: আহার গ্রহণ শেষে চুন সুপারি খয়ের সহযোগে পান মুখে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ চিবিয়ে চিবিয়ে পানের রস খাওয়া হয়। কেউ কেউ শুধু চিবিয়ে পানের পিক ফেলে দেয়। বয়স্কদের মধ্যে যাদের দাঁত নেই, তারা পান সুপারি ইত্যাদি থেতলে খেয়ে থাকেন। শহরের বড় বড় রেস্তোরায়ও পান পরিবেশন করা হয়। এছাড়া শহরে গঞ্জে অলিতে গলিতে খিলি পানের দোকানে বহুবিধ সুগন্ধি মসলাযোগে পানের খিলি বিক্রি করা হয়। পাড়া মহল্লার বিড়ি সিগারেটের দোকানেও খিলি পান বিক্রি হয়। হাটে-বাজারে বাসাবাড়িতে খাওয়ার জন্য পান-সুপারির আলাদা দোকান রয়েছে। সেখানে বিরা হিসেবে পান বিক্রি হয়।
পান খাওয়ার আরো কিছু সুবিধা রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে- পান বলকারক ও কাম উদ্দীপক। পানের রস রাতকানা রোগ নিরাময়ে সহায়ক। পান মুখের দুর্গন্ধ দূর করে ও হজমশক্তি বাড়ায়। উকুননাশক হিসেবেও পানের রস কাজ করে। পান খেয়ে লাল করা ঠোঁট নরনারীকে আকৃষ্ট করে। এছাড়া সুপারিতে রয়েছে মুখের জীবাণুনাশক ও কৃমিনাশক শক্তি। চুনের ক্যালসিয়াম পাকস্থলির পরিপাক শক্তিবর্ধক, যৌন উদ্দীপক, রক্ত পরিষ্কারক। খয়েরে আছে রক্তবর্ধক ও পরিষ্কারক আয়রন। তবে পান খাওয়ার অপকারিতাও কম নয়। প্রথম প্রথম পান খেলে পানের রসে ঠোঁট ও মুখের ভিতরের নরম ও সেনসেটিভ কোষ পুড়ে যায় বা ক্ষয় হয় এবং মুখে জ্বালপোড়া হয়। কখনো কখনো মাথাঘোরা, ঘাম, এমনকি বমিও হতে পারে। এতে ক্ষুধামন্দা হয়। দীর্ঘদিন পান খেলে দাঁত কালো হয়ে যায়, ঠৌঁটে ও মুখের ভেতর কালো দাগ পড়ে এবং অসুন্দর দেখায়। যেখানে-সেখানে পানের পিক ফেলায় পরিবেশ দূষিত হয়। অতিরিক্ত পান খেলে হাঁপানি, রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, এমনকি হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। জর্দার নিকোটিন এবং সুপারি নেশার উদ্রেক করে। পানের সাথে চুন খেলে তা পিত্তথলিতে পাথর সৃষ্টি করতে পারে। আধুনিক গবেষণায় বলা হয় পান-সুপারি মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্যান্সার রিসার্চ এজেন্সি পান-সুপারিকে মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে মনে করে। নিয়মিত পান খেলে মুখে, জিহ্বায়, খাদ্যনালিতে এবং পাকস্থলিতে ক্যান্সার হতে পারে।