এ বছর মুন্সীগঞ্জে আলুর ভালো ফলন হলেও বাজারে দরপতনের কারণে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার কৃষকরা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ থেকে ১১ টাকায়, যা উৎপাদন খরচের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রেতার অভাব।
আশরাফ সরকার, মুন্সীগঞ্জ সদরের পঞ্চসারের একজন কৃষক এবং বেসরকারি কলেজের শিক্ষক, এ বছর ১১৫ শতাংশ জমিতে আলু চাষ করেছেন। তিনি বলেন, “প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে আমার খরচ পড়েছে ২৫ টাকা। বিক্রি করতে না পেরে সব আলু কোল্ডস্টোরে রেখেছি। এখন কোল্ডস্টোরের খরচসহ প্রতি কেজি আলুর দাম দাঁড়িয়েছে ৩২ টাকা। অথচ বাজারে এর অর্ধেক দামও পাওয়া যাচ্ছে না।”
সদরের ভাসানচরের প্রবাসফেরত কৃষক ইকবাল বলেন, “অনেক বিপদের মধ্যে আছি। কোনো ক্রেতা নেই যে আলু বিক্রি করবো।”
আড়তদার পাপ্পু সাহা বলেন, “কৃষকরা এখানে আলু রেখে যান বিক্রির জন্য। কিন্তু আলুর দাম আগের চেয়ে আরও কমেছে। বিক্রিও কম হচ্ছে।”
চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি যোগান :
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, এ বছর মুন্সীগঞ্জে ৩৫,৭৫৮ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে, যার মোট উৎপাদন প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন আলু কোল্ডস্টোরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “মুন্সীগঞ্জে গড়ে প্রতিদিন ১৬০ টন আলু ভোগ হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কয়েকগুণ বেশি। তবে কেন এই সময় দাম এত নিচে নেমেছে, সেটির নির্দিষ্ট কারণ বলা যাচ্ছে না। কোনো সিন্ডিকেট কাজ করছে কিনা, তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”
রপ্তানি বাধাগ্রস্ত, তবে সম্ভাবনাও আছে:
ডায়মন্ট জাতের আলুর প্রতি বিদেশে চাহিদা কম এবং অতিরিক্ত সার ব্যবহারের কারণে আলুতে ড্রাই ম্যাটার কম হওয়ায় রপ্তানি সম্ভাবনা কম বলেও জানান তিনি। তবে আশাব্যঞ্জক একটি দিক তুলে ধরে বলেন, “এই মৌসুমে জেলার ১৫০টি জমিতে কম সার ব্যবহার করে চাষ করে সফলতা এসেছে। যদি কৃষকরা এই পদ্ধতিতে আগ্রহী হয়, তবে ভবিষ্যতে গুণগত মান বাড়বে এবং সরকারের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার সারের ভর্তুকিও সাশ্রয় হবে।”
দরপতনের পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার ঘাটতি :
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. সামির হোসেন সিয়াম বলেন, “বর্তমানে কৃষকরা প্রতি কেজি আলু বিক্রি করছেন ১০ টাকায়, যেখানে গত বছর এই সময় ছিল ২০ টাকা। খুচরা বাজারে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়।”
তিনি আরও বলেন, “২০১৮ সালের কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী সরকার চাইলে কৃষকদের ভর্তুকি দিতে পারে। এখন সেটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।”
তবে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা নিয়ে তিনি স্বীকার করেন, দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে কোনও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ট্র্যাকিং নেই, ফলে বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী আগাম পূর্বাভাস বা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রান্তিক কৃষকরা সরাসরি বাজারে প্রবেশ করতে না পারায় এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব বেশি থাকায় প্রকৃত দাম কখনোই কৃষকের হাতে পৌঁছায় না। তদুপরি, সরকারি পর্যায়ে সংগঠিত হিমাগারভিত্তিক বাজার সংরক্ষণ পরিকল্পনার অভাব এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছ নীতির অভাব এই সমস্যাকে দীর্ঘমেয়াদে আরও বাড়িয়ে তুলছে।