বিশ্বব্যাপী বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স ও বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট আবিষ্কারের শতবর্ষ উৎযাপন চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪ সালের ৭ থেকে ১০ নভেম্বর উৎযাপিত হয় ‘Centennial Celebration of Bose-Einstein Statistics, A Legacy of Dhaka নামে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। আন্তর্জাতিক এই কনফারেন্সটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই অভ্যূত্থানের পরে বাংলাদেশে এটিই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক কনফারেন্স যেখানে বিভিন্ন দেশের ৪০ জন বিজ্ঞানী অংশগ্রহণ করেন। সেসময় কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্সের জনক বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমরা The Man Who Pervades the Universe নামে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করি এবং প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইবার প্রদর্শিত হয়।
১৯২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্স তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। পরে বসু তার আবিস্কৃত তত্ত্বটি একটি প্রবন্ধ আকারে লিখে বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশের জন্য বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে প্রেরণ করেন। প্রবন্ধটি পড়ে আইনস্টাইন এতোই মুগ্ধ হন যে তিনি নিজেই তা দ্রুত জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জার্মানের বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা Zeitschrift für Physik-এ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকেই বসুর তত্ত্বটির নাম হয় ‘বোস-আইন্সটাইন স্ট্যাটিস্টিক্স আর এভাবেই সৃষ্টি হয় কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্স। আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন সত্যেন বসু আবিস্কৃত তত্ত্বটি কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করতে চলেছে। পরে তিনি বসুর স্ট্যাটিস্টিক্সটি আদর্শ গ্যাসের উপর প্রয়োগ করে আরো একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেন যার নাম ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’ বলে বিখ্যাত হয়।
সম্প্রতি সরকারি হরগঙ্গা কলেজ প্রাঙ্গনে ‘আনন্দময় বিজ্ঞান জগতে’র আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলে গেল দিনব্যাপী বিজ্ঞান উৎসব। ‘আনন্দময় বিজ্ঞান জগৎ’ নামের এই বিজ্ঞান সংগঠনটির পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘From Wonder to Wisdom’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ‘ABJ সায়েন্স ফেস্ট ২০২৫’ নামে বিজ্ঞান উৎসবটির আয়োজন করে। উৎসবের বিভিন্ন ইভেন্টে বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। ‘আন্ত:গ্যালাক্টিক আলোয় ছুটে চলা সৌরজগৎ’ শীর্ষক বিজ্ঞান বক্তৃতা উপস্থাপন করেন দেশের বরেণ্য বিজ্ঞান বক্তা আসিফ। প্রদর্শিত হয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নির্তেশ সি দত্ত ও রুমকি রুসা নির্মিত চলচ্চিত্র The Man Who Pervades the Universe. বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা করেন বুয়েটের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, বিজ্ঞানলেখক অধ্যাপক সফিক ইসলাম ও লেখক, সাংবাদিক আব্দুল গাফফার রনি। ABJ সায়েন্স ফেস্টে ৬টি স্কুল ও ৫টি কলেজের বিজ্ঞানের প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। তারা কিউট পাজল সলভ প্রতিযোগিতায়, বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডসহ বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে সেরা ১০ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। আয়োজন করা হয় একটি বায়োলজি ওয়ার্কশপ। সন্ধ্যার পরে অন্ধকার হলে শিক্ষার্থীদের টেলিস্কোপে আকাশ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দিনব্যাপী এই উৎসবের সমাপ্তি হয়। বিজ্ঞান উৎসবে মেয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য, ৬০ ভাগের বেশি৷ উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক শহীদ ই হাসান তুহিন, চলচ্চিত্র নির্মাতা নির্দেশ সি দত্ত, রুমকী রুশা, কবি কাজী মুহাম্মাদ আশরাফ, শিল্পী ইকবাল সুমন, লেখক খালেদা ইয়াসমিন ইতি, সাংবাদিক শরিফ উদ্দিন সবুজ প্রমূখ।
গণিতের অধ্যাপক ও বিজ্ঞান লেখক সফিক ইসলামের তত্ত্বাবধানে সাইদুল হোসেন, আল-আমিন, ইমাম মেহেদী আশফি, আফসারি হোসেন ছোঁয়া, রবিউর রহমান হৃদয়, ওহাহিদুর রহমান মোহিন, মুশফিকুর রহমান, তাসতিন আলিসহ একদল উদ্যমী তরুণ-তরূণী ২০২০ সালে ‘আনন্দময় বিজ্ঞান জগৎ’ নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠিা করে গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। বিজ্ঞান শিক্ষাকে শুধুমাত্র একাডেমিক জায়গায় আবদ্ধ রাখার অভিযোগ থেকেই ‘আনন্দময় বিজ্ঞান জগতে’র জন্ম। পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার জন্য সবাই বিজ্ঞান শিখছে- এমন ধারণাকে ভেঙ্গে দিয়ে বিজ্ঞানের আনন্দময়তাকে ছড়িয়ে দেওয়াই সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য। সে লক্ষ্য নিয়েই ‘আনন্দময় বিজ্ঞান জগৎ’ কাজ করে চলেছে। দেশপ্রেমিক মানুষজন দেশের যেখানেই থাকেন দেশের জন্য কাজ করে যান। অধ্যাপক সফিক ইসলাম দেশের জন্য যেসব কাজ করে চলেছেন তা প্রশংসার দাবী রাখে।
লেখক: সাংবাদিক ও ফিল্ম মেকার
